ডাউন সিন্ড্রোম

ডাউন সিন্ড্রোম কি?

মানুষের দেহের প্রতিটি কোষে নিউক্লিয়াস বিদ্যমান। এর ক্রোমোসোমে জেনেটিক উপাদান থাকে। এই ক্রোমোসোমের জীনগুলোর উত্তরাধিকার বৈশিষ্ট্য বজায় রাখার জন্য দায়ী কোড বহন করে। প্রত্যেক ক্লোষের নিউক্লিয়াস ২৩ জোড়া (৪৬ টি) ক্রোমোসোম ধারন করে এবং যার অর্ধেক পিতা বা মাতার থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া যায়।

ডাউন সিন্ড্রোম হয়ে থাকে যখন ২১ নাম্বার ক্রোমোসোমটির সঙ্গে আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে আরেকটি ক্রোমোসোম (Trisomy 21) সন্নিবেশিত থাকে। এই অতিরিক্ত জেনেটিক উপাদানটি জেনেটিক বৈশিষ্ট্যের প্রকাশে বাধা দেয় এবং ডাউন সিন্ড্রোমে ডেভলপ করতে সহায়তা করে।
সাধারণ কিছু শারিরিক বৈশিষ্ট্য দেখে বুঝা যায় যে, কোনো শিশু ডাউন সিন্ড্রোমে আক্রান্ত কিনা।

বৈশিষ্ট্য গুলো-
১। মাংসপেশির শিথিলতা।
২। বামন বা কম উচ্চতা।
৩। চোখের কোনা উপরের দিকে উঠানো।
৪। চভেপ্টা নাক।
৫। ছোট কান
৬। হাতের তালুতে একটি মাত্র রেখা।
৭। জিহ্বা বের হয়ে থাকা ইত্যাদি।

ডাউন সিন্ড্রোমের হারঃ
CDCP(Centers for Disease Control & Prevention) এর রিপোর্ট অনুযায়ী প্রতি ৭০০ শিশুর মধ্যে ১ টি ডাউন সিন্ড্রোম নিয়ে জন্মগ্রহন করে। আমেরিকায় প্রতি বছর প্রায় ৬০০০ শিশু ডাউন সিন্ড্রোম নিয়ে জন্মায়।

ডাউন সিন্ড্রোমের আবিষ্কারঃ
১৯ শতকের পূর্বে মানূষ এই রোগটি সম্পর্কে কিছুই জানতো না। সর্বপ্রথম ১৮৬৬ সালে ব্রিটিশ চিকিৎসক জন ল্যাঙ্গডন ডাউন এই রোগের রোগী চিহ্নিত করেন। ওনার নাম অনুসারে ডাউন
সিন্ড্রোম নামকরণ করা হয়। মি. ডাউন স্বতন্ত্র এবং আলাদা ভাবে এই রোগের অস্তিত্ব বর্ণনা করেন। এ জন্যই উনাকে “Father of Down Syndrome” বলা হয়।
সাম্প্রতিক সময়ে ডাউন সিন্ড্রোমে আক্রান্ত শিশুর বৈশিষ্ট্যগুলো বিজ্ঞান আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছে।

১৯৫৯ সালে ফ্রান্সের চিকিৎসক Jerome Lejeune শনাক্ত করেছেন যে, এটা একটা ক্রোমোসোমাল সিন্ড্রোম। প্রতিটা কোষের নিউক্লিয়াসে স্বাভাবিক ৪৬ টি ক্রোমোসোমের পরিবর্তে এই সিন্ড্রোমে ৪৭ টি ক্রোমোসোম দেখা যায়। এ ছাড়া ২১ নাম্বার ক্রোমোসমের সমস্যা হওয়ায় এই ডউন সিন্ড্রোম হয়ে থাকে।

বিভিন্ন ধরনের ডাউন সিন্ড্রোমঃ ৩ ধরনের ডাউন সিন্ড্রোম আছে।
১। Trisomy 21 (Nondisjunction)
২। Traslocation
৩। Mosaicism

Trisomy 21 (Nondisjunction) :
ডাউন সিন্ড্রোম সধারনত কোষ বিভাজনের অস্বাভিকতার কারনে হয়ে থাকে। একে ননডিসজাংশন বলা হয়। ননডিসজাংশনে ২১ নাম্বার ক্রোমোসমের ২টি কপির পরিবর্তে ৩টি কপি শুরু হবে। বন্ধনের ক্ষেত্রে ওই ক্রোমোসম শুক্রানু বা ডিম্বানুর সাথে যুক্ত হতে ব্যার্থ হয় এবং এই অতিরিক্ত ক্রোমোসম অন্য কোষে রেপ্লিকেশন শুরু করে দেয়। ডাউন সিন্ডোমের মধ্যে ৯৫% রোগীর এই রোগ হয়ে থাকে ।

Traslocation:
কোষের ৪৬টা ক্রোমোসমের মধ্যে ২১নাম্বার ক্রোমোসমটি সম্পূর্ন বা আংশিক অন্যক্রোমোসমের (সাধারনত ১৪ নাম্বার ক্রোমোসম) সাথে যুক্ত হয়। ডাউন সিন্ডোমের মধ্যে ৪% রোগীর এই রোগ হয়ে থাকে ।

Mosaicism:
এইক্ষেত্রে ২ প্রকার কোষে মিশ্রণ ঘটে। কিছু কোষে ৪৬টি ক্রোমোসম থাকে এবং কিছুতে থাকে ৪৭টি ক্রোমোসম। এই ৪৭টি ক্রোমোসমের মধে ২১ নাম্বার ক্রোমোসম অতিরিক্ত থাকে। ডাউন সিন্ডোমের মধ্যে ১% রোগীর এই রোগ হয়ে থাকে ।

কি কারণে ডাউন শিশুর জন্ম হয়:
ঠিক কি কারণে সিন্ড্রোম শিশুর জন্ম হয় তা সম্পূর্ণ জানা যায়নি। তবে একথা প্রমাণিত যে কোন নারী যত অধিক বয়সে মা হবেন, তার সন্তান ডাউন সিন্ড্রোম শিশু হবার সম্ভাবনাও তত বেশী হবে। যেমন ২৫ বছর বয়সের প্রতি ১২০০ জন গর্ভবতী মায়ের মধ্যে একজনের, ৩০ বছর বয়সের প্রতি ৯০০ জন মায়ের মধ্যে একজনের ডাউন সিন্ড্রোম শিশু হতে পারে। কিন্তু ৩৫ বছর বয়সের পর ঝুঁকি দ্রুত বাড়তে থাকে। ৩৫ বছর বয়সের প্রতি ৩৫০ জন গর্ভবতী মায়ের মধ্যে একজনের এবং ৪০ বছর বয়সের প্রতি ১০০ জন মায়ের একজনের ডাউন শিশু হতে পারে। অধিক বয়সের মায়ের গর্ভে ডাউন সিন্ড্রোম শিশু হবার সম্ভাবনা বাড়লেও যেহেতু যুবতী বয়সেই বেশীরভাগ নারী মা হয়ে থাকেন তাই যুবতী বয়সের মায়েদের মধ্যেই ডাউন সিন্ড্রোম শিশু সচরাচর দেখা যায়। তার মানে যে কোন বয়সের মায়ের ডাউন সিন্ড্রোম শিশু হতে পারে। অন্যদিকে কোন মায়ের আগে একটি ডাউন সিন্ড্রোম শিশু থাকলে পরবর্তীতে ডাউন সিন্ড্রোম শিশু হবার সম্ভাবনা বাড়ে। পরিবেশ দূষণ, গর্ভবতী মায়ের ভেজাল খাদ্যে ও প্রসাধনী গ্রহণ, তেজস্ক্রিয়তা ইত্যাদি কারণেও ডাউন সিন্ড্রোম শিশুর জন্ম হতে পারে বলে ধারনা করা হয়। অনেক সময় বাবা-মা ক্রুটি যুক্ত ক্রোমোজমের বাহক হলে তাদের সন্তানও ডাউন সিন্ড্রোম শিশু হতে পারে।

ডাউন সিন্ড্রোম হওয়ার সম্ভাব্যতাঃ
বয়স্ক মহিলারা সন্তান নিলে এ রুগীর সংখ্যা বেড়ে জেতে পারে।যেমন-৩৫ বছর বয়সের মহিলার ক্ষেত্রে প্রতি ৩৫০ জন গর্ভবতী মায়ের মধ্যে ১জনের সন্তনের এ রোগ হতে পারে। আরও বয়স্ক হলে এর ঝুঁকি আরও বেড়ে যায়। নিম্নে ১টা ছক দেওয়া হল।

​সুযোগ ও সচেতনতার অভাবে আমাদের দেশে এখনো বেশীরভাগ গর্ভবতী মা চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থাকতে পারেননা। অন্যদিকে চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থাকলেও গর্ভবতী মাকে ডাউন সিন্ড্রোম শিশু সম্পর্কে বা অন্য কোন জন্মগত ত্রুটি সম্পর্কে ধারণা দেয়ার ব্যপারটি উপেক্ষিত। তাছাড়া দেশের সব জায়গায় পরীক্ষা নিরীক্ষা করার সুযোগ নেই। তাই ডাউন সিন্ড্রোম হওয়ার সম্ভাব্যতা বৃদ্ধি পায়।

২য় সন্তানের ডাউন সিন্ড্রোম হওয়ার সম্ভাব্যতাঃ
একজন মহিলা পূর্বে trisomy অথবা translocation রোগের মতন কোন সন্তান জন্ম দেয়,তাহলে তার পরিবরর্তি সন্তানের এ রোগ হওয়ার সম্ভ্যবত বেশি।

চিকিৎসাঃ
একজন চিকিৎসক যে কোন বয়সের শিশুকে দেখেই ডাউন সিন্ড্রোম শিশু কিনা তা সন্দেহ করতে পারেন। কারন তাদের কিছু নির্দিষ্ট শারীরিক বৈশিষ্ট্য থাকে। বাবা মায়েরা যখন দেখেন তাদের সন্তানের চেহারা একটু ভিন্ন ধরনের, শিশুর গায়ে শক্তি কম, নির্ধারিত বয়সে বসতে, দাঁড়াতে বা হাঁটতে শিখছেনা, শারীরিক বৃদ্ধি কম, কম বুদ্ধি সম্পন্ন, তখন তারা চিকিৎসকের সরনাপন্ন হন। চিকিৎসক শিশুর রক্তের ক্রোমোজম সংখ্যা বা ক্যারিওটাইপিং পরীক্ষার মাধ্যমে ডাউন সিন্ড্রোম শিশু কি না তা নিশ্চিৎ করেন। ১১ হতে ১৪ সপ্তাহের মধ্যে গর্ভবতী মায়ের রক্তে প্যাপ-এ, এইচসিজি এবং ১৬ হতে ২০ সপ্তাহের মধ্যে এএফপি, ইসট্রিয়ল, এইচসিজি ইত্যাদি রাসায়নিক পদার্থের মাত্রা পরীক্ষা করে ডাউন সিন্ড্রোম শিশুর জন্ম হওয়ার ঝুঁকি সম্পর্কে ধারনা করা যায়। তাছাড়া আল্ট্রাসনোগ্রাফী করে মায়ের পেটে ১১ হতে ১৪ সপ্তাহের শিশুর ঘাড়ের পিছনের তরলের মাত্রা, নাকের হাড়ের উপস্থিতি, “ডাকটাস্ ভেনোসাস” নামক প্রাথমিক রক্তনালীর রক্তপ্রবাহ ইত্যাদি নির্নয়ের মাধ্যমেও ডাউন সিন্ড্রোম শিশু জন্ম নেয়ার ঝুঁকি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। পরীক্ষা-নিরীক্ষার রিপোর্ট অনুযায়ী উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ হিসাবে চিহ্নিত মায়েদেরকে ডাউন সিন্ড্রোম শিশুর নিশ্চিত পরীক্ষা করার উপদেশ দেয়া হয়।গর্ভাবস্থার ১১ হতে ১৪ সপ্তাহের মধ্যে প্রাথমিক গর্ভফুল হতে কোষকলা সংগ্রহের মাধ্যমে অথবা ১৫ হতে ১৮ সপ্তাহের মধ্যে গর্ভের বাচ্চার চারপাশের তরল পদার্থ সংগ্রহের মাধ্যমে বাচ্চার ডিএনএ পরীক্ষা করে গর্ভের বাচ্চাটি ডাউন শিশু কি না তা ১০০ ভাগ নিশ্চিত করা যায়। এ সময় বাচ্চার আকার হয় প্রায় ২-৪ ইঞ্চির মতো। কাজেই রিপোর্ট অনুযায়ী বাবা-মা গর্ভাবস্থা চালিয়ে যাওয়ার ব্যপারে নিশ্চিৎ হয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।

জন্মের পর সাধারণত অনেক এ ধরনের বাচ্চার হার্ট এ সমস্যা থাকে। এর জন্য প্রয়োজনে সার্জারি করতে হয়। অনেক বাচ্চার বিকাশগত সমস্যা থাকতে পারে, যেমন সামাজিক মেলামেশায় সমস্যা, কথা বলায় দেরি, বিভিন্য সেন্সরি সিস্টেম এ সমস্যা ইত্যাদি; এগুলোর জন্য নিয়মিত বিভিন্য থেরাপি নিয়ে যেতে হয়।

ডাউন সিন্ড্রোমের উপর সমাজের ভূমিকাঃ

ডাউন সিন্ড্রোম আক্রান্ত বাচ্চাদের সামাজিক এবং যোগাযোগের ক্ষেত্রে কার্যকর করার জন্য আলাদাভাবে প্রতিষ্ঠান, স্কুল, স্বাস্থ্য সেবা, কর্মস্থল, বিনোদন ক্ষেত্র তৈরী করতে হবে। এ সব বাচ্চাদের হাল্কা থেকে গুরুতর বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক বিকাশ গত সমস্য থাকতে পারে। এদের জ্ঞান হালকা থেকে মাঝারি ধরনের হয়ে থাকে।

চিকিৎসা প্রযুক্তির অগ্রগতির কারনে এ রোগের ব্যাক্তিরা আগের চেয়ে বেশি দিন বেঁচে থাকে।
১৯১০ সালেও এ রোগীরা শুধু ১ম বছরের বেশি বাঁচতো না, কিন্ত এন্টিবায়োটিক আবিষ্কারের কারনে গড় বেঁচা থাকার বয়স ১৯-২০ বছর পর্যন্ত বেড়ে যায়। ক্লিনিক্যাল চিকিৎসার কারনে বিশেষ করে হার্ট সার্জারিতে উন্নতির ফলে ডাউন সিন্ড্রোমের ৮০% রোগীরা এখন ৬০ বাছর পর্যন্ত বেঁচে থাকে। ডাউন সিন্ড্রোমের ক্ষেত্রে সমাজের সবাইকে এগিইয়ে আসতে হবে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top