বাচ্চা কি অমনোযোগী ও অতি চঞ্চল?

আমাদের অনেকেরই বাচ্চা একই বয়সের অন্যান্য বাচ্চার চেয়ে অনেক বেশি চঞ্চলতা প্রদর্শন করে থাকে। আবার অনেকে স্কুলে গেলেও মনোযোগের মারাত্মক অভাবে পড়ালেখায় ভাল করতে পারে না। অনেকে স্কুলে মাত্রাতিরিক্ত দুষ্টামি প্রদর্শন করে এবং অভিভাবক দের এর জন্য যথেষ্ট ঝক্কি পোহাতে হয়। আজকে এই ধরনের বাচ্চাদের নিয়ে আলোচনা করব যাতে সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে তাদের জীবন কে আরও সুন্দর ও সাফল্য মণ্ডিত করা যায়।

আমরা যে ধরনের সমস্যাটির কথা আলোচনা করতে যাচ্ছি তা হল ‘অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপার অ্যাক্টিভ ডিজঅর্ডার’ অর্থাৎ, বাচ্চার মনোযোগের অভাব এবং অতি-চঞ্চলতা জনিত সমস্যা। এটি একটি মস্তিস্কের বিকাশগত (নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল) সমস্যা। আসুন দেখি এই ধরনের বাচ্চারা কি কি ধরনের উপসর্গ প্রদর্শন করেঃ

অমনোযোগিতাঃ

  • অনেক সময় কোন বিষয়ে বিষদ চিন্তা করে না, ক্লাসে বা অন্য কোন কাজে খুবি সাধারন ভুল করে যা ওই বয়সে অস্বাভাবিক।
  • অনেক সময় কোন সাধারন অথবা খেলাধুলার কাজে বেশিক্ষণ মনোযোগ ধরে রাখতে পারে না।
  • অনেক সময় তার সাথে কথা বলতে গেলে মনে হয় সে আনমনে আছে, শুনতে পাচ্ছে না।
  • অনেক সময় ক্লাসে বা অন্য কোন কাজে ইন্সট্রাকশন ফলো করতে পারে না, যার কারনে কোন প্রদত্ত কাজ শেষ করতে সমস্যা হয় (যেমন একটি কাজ করতে করতে অন্য দিকে বা অন্য কোন কাজে মগ্ন হয়ে যাওয়া)।
  • অনেক সময় কোন কাজ গুছিয়ে করতে পারে না, এলো মেলো করে ফেলে।
  • অনেক সময় দীর্ঘক্ষণ মাথা খাটিয়ে কাজ করতে হয় এমন কোন বিষয়কে এড়িয়ে চলে বা একেবারেই করতে চায় না (যেমন স্কুলে ক্লাসের কাজ, বাড়ির কাজ, অঙ্ক করা ইত্যাদি)।
  • অনেক সময় প্রাত্যাহিক কাজের জিনিস পত্র যেমন পেন্সিল, রাবার, বই, খাতা ইত্যাদি বারে বারে হারিয়ে ফেলে।
  • অনেক সময় কোন কাজ করার সময় অল্পতেই অন্য কোন দিকে মনোযোগ ঘুরে যায়।
  • অনেক সময় দৈনন্দিন জিবনের সাধারন কাজ যেমন দাঁত মাজা, গোসল করা, চুল আঁচড়ানো ইত্যাদি ভুলে যায়।

অতি-চঞ্চলতাঃ

  • অনেক সময় হাত বা পা কাঁপাতে থাকে অথবা চেয়ারে বসলে সামনে পিছনে অথবা পাশাপাশি হেলাদুলা করতে থাকে।
  • অনেক সময় কোথাও বসে থাকার কথা থাকলেও হঠাত করে উঠে পড়ে।
  • অনেক সময় হঠাত করে দৌড় দেয় অথবা কোথাও উঠে পড়ে, যে আচরণ সেই সময়ে বা পরিবেশে কারো কাম্য নয়।
  • অনেক সময় শান্ত ভাবে খেলাধুলায় অংশগ্রহন করতে পারে না।
  • অনেক সময় এমন ভাবে দৌড়ায় যেন দেখে মনে হয় কোন মোটর গাড়ি যাচ্ছে।
  • অনেক সময় মাত্রাতিরিক্ত কথা বলে।
  • অনেক সময় প্রশ্ন করার আগেই উত্তর দেয়ার চেষ্টা করে।
  • অনেক সময় কোন কিছুর জন্য লাইনে অথবা অন্য কোন ভাবে অপেক্ষারত অবস্থায় নিজের সময় আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারে না।
  • অনেক সময় অন্যদের কথা বা কাজে বাধা দেয়, যেমন কোন দুজন কথা বলছে অথবা খেলছে, তাদের মধ্যে অনাহুত ভাবে ঢুঁকে পড়ে।

উপরের আলোচনা থেকে আমরা ‘অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপার অ্যাক্টিভ ডিজঅর্ডার’ এর উপসর্গ গুল জানলাম। তবে কারো কারো অমনোযোগিতা বেশি থাকে, কারো অতি-চঞ্চলতা বেশি থাকে আবার কারো কারো অমনোযোগিতা ও অতি-চঞ্চলতা দুটাই সমান তালে থাকে। আবার সবগুল উপসর্গই যে থাকতে হবে এমন কোন কথা নেই। এর জন্য কিছু নির্দিষ্ট ক্রাইটেরিয়া রয়েছে। যদি আপনি মনে করেন আপনার বাচ্চার আচরণের সাথে উপরের উপসর্গ গুল কিছু কিছু মিলে যায়, তাহলে এ ব্যপারে একজন অভিজ্ঞ পেশাজীবীর সাথে কথা বলে নিশ্চিত হয়ে নিন।

এধরনের বাচ্চাদের এখনো আমাদের সমাজে অতি দুষ্ট অথবা যাদের কেবল অমনোযোগিতা বেশি তাদের হাবা গোবা বলা হয় এবং স্কুল থেকে তাদের বিরুদ্ধে শিক্ষক ও অন্যান্য বাচ্চার বাবা মার কাছ থেকে প্রতিনিয়ত অভিযোগ আসে। এর জন্য বাচ্চাকেই শেষ পর্যন্ত দায়ী করা হয়। পশ্চিমা গবেষণায় দেখা গেছে স্কুল গামী ৬%-৭% বাচ্চা ‘অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপার অ্যাক্টিভ ডিজঅর্ডার’ এ আক্রান্ত। আমাদের দেশে এর মাত্রা একই হবে বলে ধরে নেয়া যায়। তবে সচেতনতার অভাবে এই বাচ্চা গুলর শিক্ষা জীবন, সামাজিক জীবন মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়।

কেন হয়?
‘অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপার অ্যাক্টিভ ডিজঅর্ডার’ এ আক্রান্ত হবার কারন এখনো পরিপূর্ণ ভাবে জানা যায়নি। তবে এই সমস্যা তৈরি হবার পিছনে জেনেটিক ফ্যাক্টর, পরিবেশ এর ভুমিকা, সামাজিক ও পারিবারিক পরিবেশের ভুমিকা রয়েছে বলে গবেষণায় প্রমান পাওয়া যায়। এগুলোর ফলে ব্রেন এর বিশেষ কিছু নিউরোট্রান্সমিটার ভাল ভাবে কাজ করতে পারেনা। যার কারনে ব্রেন এর মনোযোগ, আচরণ নিয়ন্ত্রন, মোটিভেশন ইত্যাদি কার্যক্রম ব্যহত হয়।

চিকিৎসাঃ
কগনেটিভ বিহেভিয়ারাল থেরাপি, সেন্সরি ইন্টিগ্রেসন, কিছু স্টিমুলেন্ট জাতিয় ঔষধ, খাদ্য নিয়ন্ত্রন, কিছু সম্পুরক খাদ্য ইত্যাদির মাধ্যমে সমন্বিত ভাবে এই সমস্যার চিকিৎসা করতে হয়।

এ ছাড়াও উন্নত বিশ্বের মত আমাদের দেশেও এখন ‘নিউরো-ফিডব্যাক ব্রেইন ট্রেইনিং টেকনোলজি’ চালু হয়েছে যাতে বাচ্চার এধরনের সমস্যা খুব দ্রুত লাঘব হয়।

পরিশেষে বলব, ‘অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপার অ্যাক্টিভ ডিজঅর্ডার’ এ আক্রান্ত বাচ্চাদের বাবা মাকে আগে সচেতন হতে হবে। অনেকেই অধৈর্য হয়ে শারীরিক শাস্তির মাধ্যমে এই বাচ্চাদের সোজা করার চেষ্টা করেন, কিন্তু তারা নিজেরাই জানেন না, এই ধরনের আচরণ বাচ্চা ইচ্ছা করে করে না, তাদের মস্তিস্ক ঠিক ভাবে কাজ করছে না বা বিকশিত হচ্ছে না। তাই এখনি সচেতন হন, আপনার বাচ্চার ‘অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপার অ্যাক্টিভ ডিজঅর্ডার’ থেকে থাকলে বাব মা, পরিবার, শিক্ষক, চিকিৎসক সকলে মিলে সমন্বিত ভাবে কাজ করলে আপনার বাচ্চার ভবিষ্যৎ অন্য রকম হতে পারে। তাকে সেই সুযোগ করে দেয়া আমাদের সকলের কর্তব্য।

অগাস্ট, ২৯, ওসমান, পোষ্ট গ্রাড, নিউরো রিহ্যাব (ইউ কে), প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ সোসাইটি অব নিউরো-ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রিসার্চ ট্রাস্ট।

INDR:
01931405986