এ টু জেড অব অটিজম

অটিজম আজ শুধু সারা পৃথিবীতেই নয় আমাদের দেশেও বহুল আলোচিত একটি শব্দ। তবে আমাদের অনেকেরই এই শব্দ টি জানা থাকলেও প্রকৃত ভাবে এই শব্দটি কেন বহুল আলোচিত তা সম্পর্কে ধারণা নেই। আজকে আমরা অটিজমের ক্ষেত্রে সাধারন ভাবে যা সকলেরই জানা দরকার তার আদ্যোপান্ত আলোচনা করব।

অটিজম একটি মানসিক বিকাশ গত সমস্যা যা সাধারনত জন্মের পর প্রথম তিন বছরের মধ্যে হয়ে থাকে। এই সমস্যার দরুন মস্তিস্কের সামাজিক বিকাশ ও সামাজিক যোগাযোগ যেমন কথা বলা, ভাব বিনিময় করার ক্ষমতা বৃদ্ধি বাধা প্রাপ্ত হয়।

অটিজম এর কারণঃ

অটিজম মস্তিস্কের অস্বাভাবিক বায়োলজি ও কেমিস্ট্রি এর ফলে সৃষ্ট একটি সমস্যা। এখন পর্যন্ত এই সমস্যার কোন সরাসরি কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি। সারা পৃথিবীতেই এই সমস্যার কারণ জানার জন্য গবেষণা অব্যাহত রয়েছে। তবে মোটামুটি ভাবে কিছু বিষয়ের সমন্বয়ে অটিজম ঘটে থাকে বলে বিজ্ঞানিরা ধারণা করে থাকেন। এদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে জেনেটিক ফ্যাক্টর। অনেক সময়ই দেখা গেছে অটিজম এর ইতিহাস যে পরিবারের আছে সেই পরিবারের আরও অনেকরই কথা বলতে সমস্যা, অন্যান্য জেনেটিক্যাল সমস্যা ইত্যাদি পাওয়া যায়। এ ছাড়াও আরও কিছু বিষয় কে সন্দেহ করা হয় অটিজম এর জন্য, এগুল হল গরভাবস্থায় খাদ্যাভ্যাস, বাচ্চার অন্ত্রের পরিবর্তনগত সমস্যা, মার্কারির (পারদ) বিষক্রিয়া, বাচ্চার ভিটামিন ও খনিজ পদার্থ পরিপাক করতে না পারা, টীকা এর প্রতিক্রিয়া ইত্যাদি।

টীকা দান ও অটিজমঃ

উন্নত বিশ্বে অনেক বাবা মাই আশংকা প্রকাশ করেন যে বাচ্চাদের প্রদেয় টীকা গুল হয়ত নিরাপদ নয়। অনেক সময়ই তারা তাদের ডাক্তার বা স্বাস্থ্য কর্মীদের কাছে তাদের এই আশংকা ব্যক্ত করেন, এমনকি তারা বাচ্চাকে টীকা দিতে অস্বীকৃতি ও জানান। অনেকেই বিশ্বাস করেন যে, মাল্টি ডোজ টীকার মধ্যে প্রিজারভেটিভ হিসাবে যে সামান্য পরিমান মার্কারি (থাইমেরোজাল) ব্যাবহার করা হয়, তার থেকে অটিজম হতে পারে। তবে এখন পর্যন্ত এই বিশ্বাসের পিছনে কোন গবেষণা লব্ধ ফলাফল এর পূর্ণ সমর্থন পাওয়া যায়নি। আমেরিকান অ্যাকাডেমি অব পেডিআট্রিক্স এবং ইন্সিটিউট অব মেডিসিন এর মতে টীকা সমূহ সামগ্রিক ভাবে যে উপকার সাধন করে, তার তুলনায় এ ধরণের ঝুকি নিতান্তই তুচ্ছ। এখন অবশ্য সকল মাল্টি ডোজ টীকারই একক ডোজ বাজারে পাওয়া যায় যাতে কোন মার্কারি মেশানোর প্রয়োজন পড়ে না।

কত সংখ্যক বাচ্চা অটিজম এ আক্রান্ত?

আমাদের দেশে এধরনের কোন সার্ভে বা গবেষণা আছে বলে জানা নেই। তবে এখন আমাদের আশেপাশে অনেক বাচ্চাই আমরা দেখতে পাই যাদের অটিজম রয়েছে। তবে এই বিষয়ে মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধি ও হয়তবা এই সমস্যা বেশি চোখে পড়ার পেছনে ভুমিকা রেখেছে। আজ থেকে ১০ বছর আগেও হয়ত এধরনের সমস্যার অধিকারি বাচ্চাদের হাবাগোবা বা এধরনের কিছু একটা বলা হত। অনেককে পড়াশুনায় চরম অমনোযোগী আখ্যা দিয়ে লেখা পড়ার পাঠ চুকিয়ে কাজে পাঠিয়ে দেয়া হত। কিন্তু এখন তাদের জন্য বিশেষায়িত চিকিৎসা ও শিক্ষা ব্যবস্থা চালু হবার দরুন তাদের এই হতভাগ্য জীবন থেকে মুক্তি দেবার একটি প্রচেষ্টা সরাকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে আমাদের সমাজে চালু হয়েছে, যা নিঃসন্দেহে একটি যুগান্তকারী উন্নয়ন।

অটিজম এর লক্ষন সমূহঃ

সাধারনত ১৮ মাস থেকে ২ বছর বয়স এর মধ্যে মা বাবা বাচ্চার আচরণে অস্বাভাবিকতা বা সাধারনের চেয়ে ভিন্ন বলে ধরতে পারেন। এর মধ্যে রয়েছে অন্য একই বয়সের বাচ্চা দের চেয়ে খেলার আগ্রহে ভিন্নতা, সামাজিক মেলামেশা যেমন কথা বার্তা বলা বা আকার ইংগিতের মাধ্যমে ভাব প্রকাশ করার ভিন্নতা ইত্যাদি। কিছু কিছু বাচ্চা আবার ১ থেকে ২ বছর বয়স পর্যন্ত খেলাধুলা কথা বার্তা সবি ঠিক থাকে কিন্তু হটাত করে কথা বার্তা ও সামাজিক মেলামেশা বন্ধ করে দেয়। এটাকে বলা হয় রিগ্রেসিভ অটিজম।

অটিজম এ আক্রান্ত বাচ্চাদের কেউ কেউ বেশিরভাগ সময় শব্দ, গন্ধ, স্পর্শ ইত্যাদি তে বেশি সংবেদনশীল থাকে। অটিস্টিক বাচ্চারা তাদের রুটিন মাফিক কাজে ব্যত্যয় ঘটলে রেগে যায়। তাদের বিভিন্ন জিনিস এর প্রতি অতি দুর্বলতা দেখা যায়। অনেক সময় তারা একই শারীরিক ভঙ্গি বা অঙ্গ সঞ্চালন বার বার করতে থাকে।

ভাব বিনিময় বা যোগাযোগের সমস্যা গুলর মধ্যে রয়েছে কাউ কে দেখলে কথা বার্তা শুরু করতে সমস্যা। অনেক সময় তারা কথা বলার পরিবর্তে আকার ইঙ্গিতে বুঝাতে চায়। অনেকেই অনেক দেরি করে কথা বলে আবার অনেকে একেবারেই কথা বলতে পারে না। অন্যরা যে দিকে তাকিয়ে থাকে সেই দিকে তাদের দেখা দেখি তাকায় না, অনেক সময় আঙ্গুল দিয়ে কোন দিকে নির্দেশ করলেও সেদিকে তাকায় না। যারা কথা বলতে পারে তারা অনেক সময় একি কথা, শব্দ, পছন্দের টিভি বিজ্ঞাপনের কথা বা গান বার বার বলতে থাকে।

সামাজিক সম্পর্ক তৈরির ক্ষেত্রেও দেখা যায় ভিন্নতা। অটিস্টিক বাচ্চারা অনেক সময় বন্ধুত্ব তৈরি করে না, একসাথে খেলতে হয় এমন কোন খেলা খেলতে আগ্রহি হয় না, অনেক সময় নিজেকে গুটিয়ে রাখে, মানুষের সাথে কথা বলার সময় চোখে চোখ রেখে কথা বলে না, একা একা সময় কাটাতে চায়। অনেক সময় অটিস্টিক বাচ্চারা অন্য বাচ্চা বা ব্যক্তির প্রতি সহানুভুতিশিলতা প্রদর্শন করে না। অনেক সময় যে কাজ সে করছে তাতেই আটকে যায়, বার বার করতে থাকে। অনেক অটিস্টিক বাচ্চা সাধারনের চেয়ে অনেক বেশি চঞ্চলতা প্রদর্শন করে । আবার অনেকে এতটাই নিঃস্পৃহ যে তাদের কোন কিছুই করতে ভাল লাগে না।

সাইন ও টেস্টঃ

সকল বাচ্চা কেই উচিৎ নিয়মিত বিরতিতে পেডিয়াট্রিক বিশেষজ্ঞ, নিউরো রিহ্যাবিলিটেশন বিশেষজ্ঞ অথবা অকুপেশনাল থেরাপিস্ট কে দেখানো যাতে বাচ্চার যে বয়সে যা যা করা উচিৎ সেই বয়সে তাই করছে কিনা, শারীরিক ও মানসিক বিকাশে কোন সমস্যা আছে কিনা তা জানা যায়। যদি দেখেন আপনার বাচ্চা নিচের কাজ গুল করছে না তাহলে আপনার উচিৎ হবে বিশেষজ্ঞের সাথে দেখা করে নিশ্চিত হয়ে নেয়াঃ

  • বার মাস বয়সের মধ্যে মুখ দিয়ে বিভিন্ন শব্দ যেমন বু বু, মা মা ইত্যাদি শব্দ করা
  • বার মাস বয়সের মধ্যে হাত দিয়ে বিভিন্ন দিকে নির্দেশ করা, টাটা করা ইত্যাদি
  • ষোল মাস বয়সের মধ্যে অন্তত একটি করে অর্থবোধক শব্দ বলা
  • চব্বিশ মাস বয়সের মধ্যে অন্তত দুটি অর্থবোধক শব্দ একসাথে বলা

এছাড়া যে কোন বয়সে যদি বাচ্চা কথা বলা বা সামাজিক মেলামেশা বন্ধ করে দেয়, তাহলে সাথে সাথে বাচ্চাকে বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যেতে হবে।

বাচ্চা অটিস্টিক কিনা তা যাচাই এর জন্য কোন পাথলজিক্যাল টেস্ট নেই। তবে এই বিষয়ে যারা পারদর্শী, তারা বাচ্চার আচার আচরণ, পারিবারিক ইতিহাস ইত্যাদি বিবেচনা করে বাচ্চা অটিস্টিক কিনা তা বলতে পারেন।

চিকিৎসাঃ

অনেক ক্ষেত্রে অটিস্টিক বাচ্চা দের চিকিৎসায় ভাল ফল পাওয়া যায় যদি তা দ্রুত সম্ভব নির্ণয় করা যায়। এই চিকিৎসা হচ্ছে একটি সমন্নিত চিকিৎসা যা পেডিয়াট্রিক বিশেষজ্ঞ, নিউরো রিহ্যাবিলিটেশন বিশেষজ্ঞ, অকুপেশনাল থেরাপিস্ট, স্পিচ অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপিস্ট এবং ক্ষেত্র বিশেষে ফিজিওথেরাপিস্ট এর সহযোগিতায় প্রতিটি অটিস্টিক বাচ্চার জন্য আলাদা আলাদা ভাবে ডিজাইন করা হয়। এই ধনের বাচ্চা দের জন্য এখন বাংলাদেশেই বিশেষায়িত প্রচুর স্কুল আছে, যেখানে তাদের জন্য বিশেষ ভাবে পাঠ দানের ব্যবস্থা করা হয়। তবে এটা নির্ভর করবে তার অকুপেশনাল থেরাপিস্ট এর পরামর্শের উপর। তিনি বাচ্চার সক্ষমতা বুঝে সেই অনুযায়ী সিদ্ধান্ত দেবেন যে কোন ধরণের বিশেষ স্কুল তার জন্য ভাল হবে।

অনেক অটিস্টিক বাচ্চার কিছু মানসিক সমস্যা যেমন অতি চঞ্চলতা, অতিরিক্ত ভিতি, মনোযোগের সমস্যা, ঘন ঘন মনের অবস্থা পরিবর্তন হওয়া, বিষণ্ণতা, ঘুমের সমস্যা ইত্যাদি থাকে। এই সব ক্ষেত্রে অনেক সময় সাইকিয়াট্রিস্ট গন ঔষধের ব্যাবহার করে থাকেন।

অনেকের মতে গ্লুটিন ও ক্যাফেইন ফ্রী খাবার খেলে অটিস্টিক বাচ্চাদের অতি চঞ্চলতা কম থাকে। তবে এর স্বপক্ষে জোরালো কোন গবেষণা নেই।

মনে রাখবেন, অটিস্টিক বাচ্চাদের কোন ‘মিরাকল চিকিৎসা’ নেই। পরিবার, আত্মীয়পরিজন, সমাজ, শিক্ষক শিক্ষিকা, চিকিৎসক সহ সকলের সমন্নিত সাহায্য সহযোগিতায় একটি অটিস্টিক শিশুর জীবন হয়ে উঠতে পারে আনন্দময় ও অর্থবহুল।

‘অটিস্টিক চাইল্ড হেল্প লাইনঃ’ অটিস্টিক বাচ্চাদের পরিবার কে বিভিন্ন তথ্য দিয়ে সহযোগিতার জন্য স্বাস্থ্য বাংলা ( http://www.sasthabangla.com ) কাজ করে যাচ্ছে। আপনি যদি সন্দেহ করেন আপনার শিশুর শারীরিক বা মানসিক বৃদ্ধি যেমনটা হওয়া উচিৎ ছিল তেমনটা হচ্ছে না, তাহলে দেরি না করে স্বাস্থ্য বাংলা অটিস্টিক চাইল্ড হেল্প লাইন ( +88-04478005161 ) এ যোগাযোগ করুন। তারা আপনাকে জানিয়ে দেবে কোথায় যেতে হবে বা কি করতে হবে।

সকল শিশুর জীবন হোক আনন্দময়। ধন্যবাদ।

 

উম্মে সায়কা নীলা
সেন্সরি ইন্টিগ্রেশন স্পেশালিষ্ট ও অকুপেশনাল থেরাপিস্ট
ম্যানেজিং ডাইরেক্টর, ইন্সিটিউট অব নিউরো-ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রিসার্চ (আই এন ডি আর)
01912106259

3 thoughts on “এ টু জেড অব অটিজম”

  1. salam. i have a autistic boy. he is 16 years old. now-a-days he is read in proyash school in chittagong. at present time i m too much worried about his life. because he is now growing up boy but he has no future. where he live in future. we have no hostel system in bd. if u arrage

  2. আমি ও আমার সঙ্গীরা আগামী ১৬/১২/২০১৪ তারিখ অটিজম বিষয়ে গণসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে খুলনা থেকে পঞ্চগড় পর্যন্ত পায়ে হাঁটা কর্মসূচি গ্রহন করেছি। উক্ত কর্মসূচি বাস্তবায়নে এ লেখা অত্যন্ত কার্যকারী ভূমিকা রাখবে বলে আশা রাখছি।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top