অটিজম একটি জটিল স্নায়বিক বিকাশজনিত সমস্যা যা সাধারণত শিশুকালে প্রকাশ পায় এবং এটি সামাজিক মিথস্ক্রিয়া, যোগাযোগ, এবং আচরণে নানা সমস্যা সৃষ্টি করে। অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার (ASD) এর মধ্যে বিভিন্ন ধরনের লক্ষণ এবং ভিন্ন ভিন্ন মাত্রার প্রভাব থাকে। এই পোস্টে আমরা অটিজমের লক্ষণ এবং প্রতিকার বা অটিজম ম্যানেজমেন্ট টেকনিক নিয়ে আলোচনা করবো।
অটিজমের লক্ষণ
অটিজমের লক্ষণগুলি সাধারণত তিনটি প্রধান ক্ষেত্রে বিভক্ত করা যায়: সামাজিক মিথস্ক্রিয়া, যোগাযোগ, এবং আচরণগত বৈশিষ্ট্য।
১. সামাজিক মিথস্ক্রিয়ার সমস্যা:
চোখে চোখ রেখে কথা বলার অভাব: অটিজম আক্রান্ত শিশুরা প্রায়ই চোখে চোখ রেখে কথা বলতে অস্বস্তি বোধ করে।
অনুভূতি বোঝার ক্ষমতার অভাব: অন্যদের অনুভূতি বা মানসিক অবস্থা বোঝার এবং প্রতিক্রিয়া জানানোর ক্ষমতা কম।
বন্ধুত্ব স্থাপন এবং বজায় রাখতে সমস্যা: অটিজম আক্রান্ত শিশুরা সাধারণত অন্য শিশুদের সাথে খেলতে বা বন্ধুত্ব করতে সমস্যা অনুভব করে।
সামাজিক সংকেত বুঝতে না পারা: সামাজিক নিয়ম বা সংকেত বুঝতে এবং অনুসরণ করতে সমস্যা হয়।
২. যোগাযোগের সমস্যা:
বিলম্বিত ভাষার বিকাশ: অনেক সময় অটিজম আক্রান্ত শিশুরা কথা বলা শুরুতে দেরি করে।
অস্বাভাবিক ভাষার ব্যবহার: তারা প্রায়ই একই শব্দ বা বাক্যাংশ বারবার পুনরাবৃত্তি করে।
অঙ্গভঙ্গি এবং মুখের অভিব্যক্তি ব্যাখ্যা করতে সমস্যা: অনেক সময় তারা অঙ্গভঙ্গি এবং মুখের অভিব্যক্তি বোঝাতে পারে না বা সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারে না।
স্বল্প কথোপকথন: অনেক সময় অটিজম আক্রান্ত শিশুরা কথা বলায় অনিচ্ছা প্রদর্শন করে বা একশব্দে উত্তর দেয়।
৩. আচরণগত বৈশিষ্ট্য:
নির্দিষ্ট রুটিনে অটল থাকা: অটিজম আক্রান্ত ব্যক্তিরা একটি নির্দিষ্ট রুটিন বা ক্রিয়াকলাপ পরিবর্তনে অস্বস্তি বোধ করে।
নির্দিষ্ট বিষয় বা বস্তুতে অতিরিক্ত আগ্রহ: তারা কিছু নির্দিষ্ট বিষয় বা বস্তুর প্রতি অতিরিক্ত মনোযোগ দেয়।
সংবেদনশীলতা: আলো, শব্দ, বা স্পর্শের প্রতি অতিরিক্ত সংবেদনশীল হতে পারে।
আচরণগত পুনরাবৃত্তি: কিছু নির্দিষ্ট কাজ বা আচরণ বারবার করে।
অটিজমের ম্যানেজমেন্ট
একক কোন ঔষধ বা চিকিৎসা নেই। বিভিন্ন ধরনের থেরাপি, ব্রেইন স্টিমুলেশন, বাবা মার বাসায় ম্যানেজমেন্ট, বিশেষ শিক্ষা, আচরণগত ম্যানেজমেন্ট, ডায়েট ম্যানেজমেন্ট বিশেষ ক্ষেত্রে কিছু ঔষধ ইত্যাদির মাধ্যমে সমন্বিত ভাবে অটিজম বাচ্চাকে স্বাভাবিক ও অর্থপূর্ণ জীবনের দিকে আনার চেষ্টা করা হয়। নিচে কিছু সাধারণ ম্যানেজমেন্ট এবং সহায়তা পদ্ধতি উল্লেখ করা হলো:
১. বিহেভিয়ার থেরাপি:
অ্যাপ্লাইড বিহেভিয়ার অ্যানালিসিস (ABA): এই থেরাপি শিশুকে ইতিবাচক আচরণ শেখায় এবং নেতিবাচক আচরণ কমাতে সাহায্য করে।
ফ্লোরটাইম: খেলাধুলার মাধ্যমে শিশুদের বিকাশে সহায়তা করে।
সামাজিক দক্ষতা প্রশিক্ষণ: সামাজিক মিথস্ক্রিয়া উন্নত করার জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
২. বক্তৃতা এবং ভাষা থেরাপি:
এই থেরাপি ভাষাগত দক্ষতা উন্নত করতে সহায়ক। এতে মুখের অভিব্যক্তি এবং অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে যোগাযোগ দক্ষতা বৃদ্ধি পায়।
৩. শিক্ষা এবং বিশেষ শিক্ষা প্রোগ্রাম:
বিশেষভাবে ডিজাইন করা শিক্ষা প্রোগ্রাম অটিজম আক্রান্ত শিশুদের শেখার ক্ষমতা বাড়াতে সহায়ক। এতে ইন্ডিভিজুয়ালাইজড এডুকেশন প্ল্যান (IEP) অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
৪. ওষুধ:
কিছু ক্ষেত্রে উদ্বেগ, ডিপ্রেশন, বা ঘুমের সমস্যার জন্য ওষুধ ব্যবহৃত হতে পারে। তবে এসব ওষুধ সরাসরি অটিজম নিরাময়ে কাজ করে না, বরং সংশ্লিষ্ট লক্ষণগুলির উপশমে সহায়ক।
৫. পরিবার এবং সম্প্রদায়ের সহায়তা:
পরিবার ও সম্প্রদায়ের সক্রিয় সহায়তা অটিজম আক্রান্ত ব্যক্তির মানসিক এবং সামাজিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পরিবারের সদস্যদের প্রশিক্ষণ ও সমর্থন প্রদান করা প্রয়োজন।
পরিশেষে বলতে চাই, অটিজম একটি জটিল স্নায়বিক বিকাশজনিত সমস্যা, তবে সঠিক যত্ন ও চিকিৎসার মাধ্যমে অটিজম আক্রান্ত ব্যক্তিরা স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারে। লক্ষণগুলি সঠিকভাবে শনাক্ত করা এবং উপযুক্ত প্রতিকার গ্রহণ করা অটিজম আক্রান্ত ব্যক্তির জীবনের মান উন্নত করতে সহায়ক। পরিবার, শিক্ষক, এবং সমাজের সক্রিয় অংশগ্রহণে অটিজম আক্রান্ত ব্যক্তিরা তাদের সম্ভাবনা অনুযায়ী সর্বোচ্চ বিকাশ লাভ করতে পারে। অটিজম সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং সঠিক চিকিৎসা পদ্ধতির প্রয়োগের মাধ্যমে সমাজে এই বিশেষ ব্যক্তিদের জন্য একটি সমান সুযোগের পরিবেশ তৈরি করা সম্ভব।